রোহিঙ্গা সংকট : শরণার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে ২ লাখ রোহিঙ্গা শিশু স্বাস্থ্যঝুঁকিতে

মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে দুই লাখের বেশি শিশু ঝুঁকির মুখে আছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল-ইউনিসেফ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে। ছবি: ছবি: আশরাফুল আলম

মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ২ লাখের বেশিই শিশু, যা এবার আসা মোট শরণার্থীর ৬০ শতাংশ। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এসব শিশু স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। জরুরি ভিত্তিতে এসব শিশুর সাহায্যের দরকার।
বাংলাদেশে ২ লাখ রোহিঙ্গা শিশুর ঝুঁকিতে থাকার কথা জানিয়েছে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা প্রধান জ্যঁ লিবে গতকাল মঙ্গলবার কক্সবাজার থেকে এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন।
এবার মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ঢল অভূতপূর্ব উল্লেখ করে জ্যঁ লিবে বলেন, ‘শুধু ৪ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর এই ৬ দিনেই বাংলাদেশে এসেছে ২ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা। লোকজনের আসার এই ঢল খুব শিগগির কমবে এমন কোনো ইঙ্গিত আমরা দেখছি না। এটি একটি ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট, যার মূলে আছে শিশু। প্রাথমিক উপাত্ত অনুযায়ী শরণার্থীদের ৬০ শতাংশ শিশু।’
জ্যঁ লিবে জানান, বিভিন্ন রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এবার তাঁরা বিপুল সংখ্যায় শিশুদের দেখতে পেয়েছেন। এদের অনেকেই কয়েক দিন ঘুমাতে পারেনি, এরা দুর্বল ও ক্ষুধার্ত। এ ধরনের দীর্ঘ আর চ্যালেঞ্জিং যাত্রা শেষে এসব শিশু দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাই তাদের স্বাস্থ্যসেবা জরুরি। শিশুরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ায় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবাটাও জরুরি। এখানে অনেক প্রসূতি মাকেও তাঁরা দেখেছেন এবং অনেক শিশু এখানে জন্ম নিয়েছে বলে শুনেছেন। জরুরি ভিত্তিতে ২ লাখ শিশুর সহায়তা প্রয়োজন। মানবিক সংকটের পুরোভাগে আছে শিশুরা। এরা অবিশ্বাস্য ঝুঁকিতে আছে।
জ্যঁ লিবে আরও জানান, সব মিলিয়ে এই ২ লাখ শিশুর জরুরি সহায়তায় ন্যূনতম ৭ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার দরকার।
এদিকে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতার মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ৩ লাখ ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করছেন জাতিসংঘের কর্মকর্তারা।
রাখাইনের কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়ি ও একটি তল্লাশিচৌকিতে গত ২৫ আগস্ট রাতে সন্ত্রাসী হামলার পর সেখানে নতুন করে সেনা অভিযান শুরু হয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সীমান্তে শুরু হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আসার স্রোত।
আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না থাকলেও মিয়ানমারের সঙ্গে টেকনাফের জলসীমান্তের দক্ষিণ প্রান্তের কড়াকড়ি অনেকটা শিথিল করা হয়েছে। ফলে এখন দিনের বেলাতেই রোহিঙ্গাদের নিয়ে অনেক নৌকা এসে নোঙর করছে টেকনাফের দক্ষিণে শাহপরীর দ্বীপে। জলপথে আসা এসব রোহিঙ্গার অনেকেই ক্যাম্পে যাচ্ছে না, তারা বাস বা গাড়ি ভাড়া করে বিভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছে।
সীমান্ত শিথিল করার ব্যাপারে জানতে চেয়ে ঢাকায় বর্ডার গার্ড সদর দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বিজিবি টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মানবিক কারণে দক্ষিণের দিকে কড়াকড়ি শিথিল করা হয়েছে। প্রথম দিকে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের চিন্তাভাবনা করা হলেও পরে মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে উচ্চপর্যায় থেকে সীমান্ত শিথিল করার সিদ্ধান্ত হয়।
গতকাল শাহপরীর দ্বীপে গিয়ে দেখা গেল, কিছুক্ষণ পরপরই রোহিঙ্গাবোঝাই একটি-দুটি করে সাগরে মাছ ধরার বিরাট আকারের নৌকা সেখানে এসে নোঙর করছে। নৌকা থেকে প্রায় হাঁটুপানিতে লাফিয়ে নামছে দুর্গত রোহিঙ্গা নর-নারীর দল। তারপর লবণমাঠের ভেতর দিয়ে বেশ খানিকটা পথ হেঁটে এসে উঠছে দ্বীপের বাজারে। তারা অধিকাংশই আসছে একেবারে খালি হাতে। কারও কারও সঙ্গে একটি-দুটি পোঁটলা বা প্লাস্টিকের বস্তা। আবার বাঁশের ঝুড়িতে করে কেউ কেউ অতি দরকারি কিছু নিয়ে আসছে।
এসব লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের প্রত্যেকের গ্রামেই সেনাবাহিনী আক্রমণ করেছে আকস্মিকভাবে। কোনোমতে জীবন নিয়ে তারা পালিয়ে এসেছে। সঙ্গে বিশেষ কিছু নিতে পারেনি, এমনকি অনেকে ঘরে রাখা টাকাও আনার সুযোগ পায়নি। দ্বীপের বাজারে মসজিদের পাশে তাদের জন্য সংগ্রহ করা পুরোনো কাপড় স্তূপ করে রেখেছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। অনেকে সেখান থেকে নিজের মাপের কাপড় বেছে নিচ্ছে। পাশেই ট্রাক, ট্রাক্টরসহ নানা রকমের যানবাহন রাখা। সেখান থেকে বিজিবির তত্ত্বাবধানে তাদের টেকনাফে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার অনেকে এসে যাত্রাবিরতি দিচ্ছে হাবিয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিচতলার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে।

No comments

Powered by Blogger.